প্রাক কথা


আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করার সাথে সাথে তাঁর স্বরূপ সম্পর্কে মানুষের মনে নানা ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামী ধারনায় আল্লাহ নিরাকার। কিন্তু নিরাকার হলে'ও তিনি সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান। পবিত্র কোরানে আছে-"ওয়াল্লাহু আলা কুল্লে শাইন মুহিত।" সুতরাং সর্ব ঘটেপটে তাঁর অবস্থান। আল্লাহ বলেন যে, তিনি মানুষের গর্দানের প্রধান শিরা থেকেও নিকটে (নাহনু আক্ রাবু এলাইয়হে মিন্ হাবলিল ওরিদ)। মুমিন বান্দার কালেবে আল্লাহর আরশ (কূলুবুল মুমেনীনা আরশুল্লাহ)- একথাটিও অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাহলে মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক অতি নিবিড়। এ সম্পর্ক প্রভূ-ভৃত্যের সম্পর্ক নয়, বরং প্রেমিক-প্রেমাষ্পদের সম্পর্ক। আর এ কারণেই মানুষকে তিনি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বা আশরাফুল মখলুকাতরূপে সৃষ্টি করেছেন। প্রিয়তম মনুষ্য জাতির প্রতি ভালবাসার বশবর্তী হয়ে আল্লাহ ঘোষনা দিয়েছেন, "আমি গুপ্ত ভান্ডারের মত ছিলাম, প্রেমাবেশে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা হ'ল, তাই সৃষ্টির সূচনা করলাম (কুন্তু কানজান্ মাখফিয়ান ফা আহবাবতু আন্ ওরেফা খালাকতুল খুল্ক)।” এ সব বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, মানুষে স্রষ্টার অস্তিত্ব বর্তমান। সুতরাং কারো মনে ব্যথা দিলে, সে ব্যথা স্রষ্টাকেই দেয়া হয়। কাউকে খুশি করলে স্রষ্টা খুশি হন। মনিষিবাক্য থেকেও জানা যায় যে, একটি হৃদয় সহস্র কাবা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর। কেননা কাবা মানুষের তৈরী ঘর, কিন্তু মনুষ্য-হৃদয় খোদাতালার বারামখানা। প্রাণে দুঃখ দেয়া আর উপাসনা-গৃহ ভেঙ্গেফেলা সমান অপরাধ। এ অপরাধ থেকে দূরে থাকার জন্যে আল্লাহ এবং তার রাছুল আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা এই নির্দেশ কতটুকু পালন করেছি? নিষ্ঠুর আচরণে, অমানবিক ব্যবহারে, অসামাজিক কার্যকলাপে চারদিক আজভরে গেছে। প্রেম-প্রীতি, সাম্য-মৈত্রি, ঈমান-আকিদা ইত্যাদি আজ সমাজ-মানস থেকে নির্বাসিত। ধনৈশ্বর্য, প্রতিপত্তি ও পশু শক্তি আমাদের বিবেক, বিচার-ক্ষমতা ও ধৈর্যশক্তিকে হত্যা করেছে। ধর্মের নামে জুলুমবাজি, সত্য প্রতিষ্ঠার নামে প্রাণহীন আচার ও লৌকিকতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সমাজের সর্বত্র। আমরা যে 'আশরাফুল মখলুকাত' একথা এক রকম ভুলেই গেছি। কিন্তু মহামানবগণ, ওলী আল্লাহগণ, রাছুলের প্রতিনিধিগণ আমাদের চেতনা পূনর্জাগরণে বহু উপদেশ বাণী রেখে গেছেন। লালন শাহের ভাষায়-"এই মানুষে আছে রে মন, যারে বলে মানুষ রতন" পাঞ্জু শাহের ভাষায়-“এই মানুষে মানুষ আছে” আহসান আলীর ভাষায় - "আয়নার ভিতরে মানুষ দেখা যায়” ইত্যাদি সেই একই সত্যের শাশ্বত জয়গান।

আমরা জানি, অন্যান্য জীব অপেক্ষা মানুষকে সুন্দরতর করা হয়েছে। এ সৌন্দর্য আন্ত্রিক ও বাহ্যিক উভয়ই। কোরানে আছে "লাকাদ খালাকনাল ইনসানা ফি আহসানে তাকভীম।" অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন, “মানুষকে আমি সর্বোৎকৃষ্ট সুন্দর গঠনে সৃষ্টি করেছি।” কিন্তু মানুষ তার কর্মফলে সর্বনিকৃষ্ট হয়ে যায়। রাছুলুল্লাহ তাই দুঃখ করে বলেন, শেষ জামানায় ইসলাম শুধু কাগজ-কলমে ও মুখে সীমাবদ্ধ থাকবে। অনৈসলামিক কথায় মুসলমানরা প্রভাবিত হবে। তারা তাদের আত্মার সম্প্রসারণে উদাসীন হয়ে বাহ্যিক বিষয়াদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠবে।' আল্লাহর আদেশ মত না চলায় এদের পরিণাম সম্পর্কে কোরানে উল্লেখিত হয়েছে- “ওয়া মানলাম ইয়াহ্ কুম বিমা আন্জালাল্লাহু ফাউলায়েকা হুমুল কাফিরুন। ফাউলায়েকা হুমুল যালেমুন। ফাউলায়েকা হুমুল ফাছেকুন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ অনুসারে ফায়সালা করে না, সে ব্যক্তি কাফের এবং জালেমও ফাছেকের পর্যায়-ভুক্ত। (ছুরা মায়দা ৪৫-৪৬ আয়াত) এ প্রসঙ্গে আল্লাহর আরো একটি নির্দেশ স্মরণ করা যায়। আল্লাহ বলেন, "কুনতুম খায়রা উম্মাতী উখরিযতি লিন্নাসে তান মুরুনা বিল মারুফে ওয়া তান হাওনা আনিল মুনকারে ওয়াতুমিনুনা বিল্লাহ।” অর্থাৎ মানব মন্ডলীর মধ্যে উত্তম সম্প্রদায় তারা যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে নিজে সৎকাজ করে থাকে; সৎকাজের জন্যে অন্যকে আহবাণ করে এবং অসৎ কাজ হ'তে তাদেরকে বিরত থাকতে বলে।" (ছুরা ইমরান-১১০)

উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরো কয়েকটি আয়াতের বঙ্গানুবাদ এখানে উদ্ধৃত করা যায়।

(ক) তাদের জন্যে পার্থিব জীবন ও পরকালের সু-সংবাদ রয়েছে, যারা ঈমানকে সুদৃঢ় করে আত্নরক্ষার পথ অবলম্বন করেছে। (ছুরা ইউনুস ৬৩-৬৪ আয়াত)

(খ) যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অংগীকার বদ্ধ হয়ে সে অংগীকার ভংগ করে এবং যে বিষয় অবিচ্ছিন্ন রাখার জন্যে আদেশ আছে সেগুলো বিচ্ছিন্ন ক'রে পৃথিবীতে কলহ বাধায়, তারা যথার্থ ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা বাকারা-২৭ আয়াত)

(গ) তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান সন্তুতি আমা হ'তে বিভেদ সৃষ্টিকারক। (সূরা আনফাল-২৮ আয়াত)

(ঘ) আল্লাহর ওলিদের (বন্ধুদের) কোন ভীতি ও আশংকা নেই। (সূরা ইউনুছ-৬২ আয়াত)

(ঙ) আউলিয়াগণ পার্থিব জীবনে ও আখেরাতে কোন রূপ শোকাতুর হবে না। (হামীম সেজদা-৩১ আয়াত)

উল্লেখ্য যে, ঐ সব ওলীদের দর্জায় পৌঁছতে হলে আল্লাহর রাছুলকে অনুসরণ করা আবশ্যক। কোরানে আছে-

(ক) লাকাদ কানা লাকুম ফি রাছুলিল্লাহে উছওয়াতুন হাসানাহ।

অর্থ: রাছুলুল্লাহের মধ্যে তোমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।

(খ) রাছুলুল্লাহর অনুগত ব্যক্তি আল্লাহর অনুগত।

                  বিদ্বান ব্যক্তিদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার সর্ব ধর্মেই দেখা যায়। ইসলামী পরিভাষায় বিদ্বান কে আলেম বলা হয়। এ বিষয়ে নির্দেশ আছে-'যে ব্যক্তি আলেম পরহেজগারের পিছনে নামাজ পড়ে, সে পয়গম্বরের সাক্ষাৎ লাভ করে।' এ সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে আলেমগণ নকশা অংকিত করে, তত্ত্বজ্ঞানিগণ তা পরিষ্কার করেন।' আমরা জানি, সাধারণ আলেম মন্ডলী শরীয়তের বিধি-বিধান প্রচার ক'রে থাকেন। এতে ধর্মের বাহ্য আচারগুলো অনুসৃত হয়, ঐশি প্রেম-পিপাসা মিটে না। তত্ত্বজ্ঞানীরা তাঁদের গুপ্ত অন্তর- বিদ্যা বলে ভক্ত-মনে অধ্যাত্ম প্রেমের আকুল পিপাসা সৃষ্টি করেন। ফলে, ভক্তগণ ঐ গভীর প্রেম বা ইশক জোরে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হন। হযরত বায়োজীদ বোস্তামীর ভাষায়- 'আউলিয়াগণের অন্তঃকরণ আল্লাহর আরশ'। রাছুল (দঃ) বলেছেন, 'মানব আমার ভেদ, আমি মানবের ভেদ'। কোরান শরীফে দেখা যায়-লাইছা কামিছলিহি শাঁইয়াও' অর্থাৎ আল্লাহর অনুরূপ অপর কিছুই নেই। আল্লাহ আরও বলেছেন, "উদ-উ ইলা ছাবিলি রাব্বিকা বিল হিকমাতি ওয়াল মাউএজাতিল হাসানাতি" অর্থাৎ 'হে পয়গম্বর, তুমি লোকদিগকে জ্ঞান পূর্ণ বাক্যসমূহ ও উত্তম উপদেশ দ্বারা স্বীয় প্রভুর রাস্তার, দিকে অতি মনোরম ভাষায় আহবান কর।' এই তত্বজ্ঞান সম্পর্কে আরো একটি নির্দেশ পাওয়া যায়।

আল্লাহ বলেন, তোমাদের জন্যে আমি একটি সাধারণ পথ (শরীয়ত) এবং আর একটি খাস্ পথ (তরীকত) নির্ধারিত করেছি।' একথার ব্যাখ্যা করলে এই দাঁড়ায় যে, শরীয়ত একটি 'দেহ' আর তরীকত তার আত্মা, একটিকে বাদ দিলে অন্যটি অচল। তবে, তরীকত বা তত্বজ্ঞান সার বস্তু, দুগ্ধেতে মিশ্রিত মাখনস্বরূপ। এই তত্বজ্ঞান অর্জনের জন্য রাছুল করীমের তাকীদও স্মরণীয়। তিনি বলেন, 'অন্তঃকরণ জীবিত করার বিদ্যা অর্জন কর।' আল্লাহর নবী স্বয়ং এই তত্ত্বজ্ঞান বা তরীকত-বিদ্যা শিক্ষা দিতেন। দিবাভাগে তিনি শরীয়ত প্রচার করতেন আর নিশাভাগে মসজিদে এক নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থানকারী সংসারত্যাগী সহচরগণকে 'ইলমে তাসাউফ' বা 'তরীকত -বিদ্যা' বা 'তত্ত্বজ্ঞান' দান করতেন। সংসার বিরাগী এই সহচরগণ আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত ছিল। এঁদের থেকেই পরবর্তীকালে সূফী মতবাদ বিকাশ লাভ করে। এ তাত্ত্বিকদলের পুরোভাগে ছিলেন হজরত আলী (কঃ)। আলী সম্পর্কে রাছুল বলেন, "আনা মদিনাতুল ইলম, অ-আলী বাবুহা।" অর্থাৎ 'আমি জ্ঞানের সুরক্ষিত নগরী, আলী তার দরজা। বস্তুত আলীর তত্ত্বজ্ঞানের কথা বহু স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। আলীর ইচ্ছানুসারে আল্লাহ-থেকে প্রাপ্ত নির্দেশ রাছুলুল্লাহ আলীকে অবগত করেন নির্দেশটি এরূপ-"মানতাবা ওয়া আমানা ওয়া আমিলা আমিলান ছালিহা ফাউলায়েকা ইউ কাদ্দিল্লাহ ছা ইয়াতিহিম হাসানাতী ওয়া কানাল্লাহু গাফুরার রাহিম।" [ছুরা-ফুরকান, ৭০ আয়াত] অর্থাৎ 'যে ব্যক্তি তৌবা ক'রে-ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম লিপ্ত আছে, আল্লাহ তার পাপকার্যসমূহ পূণ্য কর্মের দ্বারা বিনিময় করবেন।' এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, 'আল্লাহ নিরানব্বই ভাগ রহমানী গুনে গুণান্বিত, একভাগ গজবী নামে অভিহিত।' [হাদিস কুদ্‌সী] আল্লাহ বলেন "ইন্না রহমাতি ছাবাকাত আলা গাদাবিই। অর্থাৎ আমার দয়া আমার ক্রোধকে পরাজিত করেছে।" আল্লাহ আরও বলেন, 'হে মুহাম্মদ পাপিগণকে সু সংবাদ দাও যে, আমি পরম ক্ষমাশীল। হে পাপিগণ, ভয় কর কেন? যখন আল্লাহতায়ালা তোমাদিগকে ক্ষমা করবেন, তখন তোমাদের পাপের লেশমাত্র থাকবে না। তবে, খাঁটী বা স্বচ্ছ অন্তর ও ঈমানে তৌবা করা চাই। তাহ'লে জাগতিক লোভ লালসা, ত্যাগ ক'রে পরকালের পাথেয় সঞ্চয়ের নিমিত্ত তরীকত ও মারেফত অনুসরণ আবশ্যক। কেননা, 'ইলমে মারেফত অর্জন করতঃ কলব দর্পন আত্নিক আলোকে আলোকিত করতে পারলে মানব ইলমে হকিকতের দ্বারা আল্লাহর জগতের অন্তর্ভূক্ত হয়।' আল্লাহ বলেন, "ওয়া ফি অন্ ফুছেকুম আফালা তুবসিরুন অর্থাৎ আমি তোমার আত্মার সাথে সংশ্লিষ্ট আছি অথচ তোমরা আমাকে অনুধাবন করতে পারছ না।” [ছুরা আযযারিয়াত, ২১ আয়াত] তিনি আরো বলেন “ফায কুরণী আজ কুরুকুম ওয়াশ কুরুলী ওয়ালা তাকফিরুন" অর্থাৎ তুমি আমাকে স্মরণ করলে আমিও তোমাকে স্মরণ করিব। তোমরা আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, অকৃতজ্ঞ হ'য়ো না।" আল্লাহর রাছুলও অকৃতজ্ঞ ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী লোককে অপছন্দ করতেন। তাঁর ভাষায়-ইন্নাল্লাহা লা ইউছলিহু আমালাল মুফছিদিনা, অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ ফ্যাসাদী লোকদের কোনকাজ সফল হতে দেন না।' এ প্রসঙ্গে পরনিন্দা থেকে বিরত থাকার জন্যেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেননা পরনিন্দা ব্যভিচারী অপেক্ষা অধিকতর জঘণ্য পাপ-'আল গিবত আসাদ্দু মিনাল জিনা।'

বস্তুত হযরত রাছুল করীম ছিলেন বিশ্ব প্রেমিক ও মারেফত তত্ত্বের আধার। তাঁর জীবনাদর্শ সর্ব মানবের অনুকরণীয় ও গ্রহণীয়। রাছুলকে ভালবাসলে খোদাকে ভালবাসা হয়। "কুল ইন্ কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহ ফাত্তাবেউনি ইউহবিবকুমূল্লাহ ওয়া ইয়াগফেরলাকুম। জুনুবাকুম ওয়াল্লাহু গাফুরুর রাহিম।' অর্থাৎ হে মুহামম্মদ (দঃ) আপনি বলে দেন, যদি তোমরা আল্লাহর সাথে মহব্বত করতে চাও তাহ'লে আমার অনুসরণ কর। এতে আল্লাহতায়ালা তোমাদিগকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন। তিনি পরম করুনাময় ও ক্ষমাশীল। (ছুরা এমরান,৩১ আয়াত)।” আল্লাহ আরও বলেন "ইন্নালাজিনা ইউবাইউনাকা ইন্নামা ইউবাইউনাল্লাহা ইয়াদুল্লাহে ফাওকা আয়াদিহিম, অর্থাৎ হে মুহম্মদ (দঃ) নিশ্চয় যারা আপনার নিকট বয়াত গ্রহণ করল বা আনুগত্যের শপথ নিল তাদের হাতের উপর আল্লাহর হাত রয়েছে।" (ছুরা ফাতা, ১০)।

উল্লেখ্য যে, নবী করীমের পরবর্তীকালে ওয়ারাসাতুল আম্বিয়াগণের সাহচর্য লাভ করার নির্দেশ আছে। আতিউল্লাহা আতিউর রাহুলী ওয়াউলিল আমরি মিনকুম, অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার তাবেদারী কর এবং রাছুলের তাবেদারী কর। ইমাম নায়েবে রাছুল ওয়ারেছুল আম্বিয়া ও মুর্শীদের তাবেদারী কর। আরো দেখা যায় "ওয়া মা আতাকুমুর রাছুলো ফাখুজুহু ওয়ামা নাহাকুম আনহু ফাআন্তাহু' অর্থাৎ রাছুল তোমাদিগকে যা দিয়েছেন, তা গ্রহণ কর। যা করতে নিষেধ করেছেন, তা ক'রোনা।"

কোরান-হাদীছ পাঠ করলে বিপুল তত্ত্ব-তথ্য অবগত হওয়া যায়। সে সব বিষয়ে আর আলোচনা করতে চাইনে। এবারে সামা বা অধ্যাত্ন সংগীত সম্পর্কে কিছু বক্তব্য রাখতে চাই। এ বিষয়ে উল্লেখিত হয়েছে যে, কেবলমাত্র তত্ত্বজ্ঞানী প্রেমিক অন্তঃকরণই হাকিকী আজদের পবিত্র সম্প্রদান দেখতে পারে। সামা বা অধ্যাত্ম সংগীত এর সহায়ক এবং আল্লাহ- সন্ধানীদের শক্তিবর্ধক। রাছুল বলেছেন "প্রেমের গান কোন সম্প্রদায়ের জন্য একান্ত আবশ্যক (ফরজ), কোন শ্রেণীর জন্যে অভ্যাস (সুন্নত) এবং কোন শ্রেণীর জন্য নিষিদ্ধ (হারাম) বস্তুত আশেক বা আল্লাহ ভক্ত লোকের জন্যে 'সামা' জায়েজ। আর গাফিল ও গোমরা ব্যক্তির জন্য 'সামা' সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ জন্যে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী ও নিজামউদ্দীন আউলিয়া সামা, গজল ও আধ্যাত্মসংগীত কে বৈধ বলে প্রচলিত করে গেছেন।

নবী ও আউলিয়াগণ স্বগৃহে যেমন নামাজ পড়ে থাকেন, তেমনি ইন্তেকালের পরেও তাঁরা নিজ নিজ কবরে সর্বক্ষণ নামাজ প'ড়ে থাকেন। পবিত্র কোরানেও এ কথার সমর্থন আছে। অথচ আজকাল মাজার জিয়ারত,

শরীফে চাদর দেয়া, সাজানো, বাতি দেয়া, আতর-গোলাপ পানি ছিটানো, আগর বাতি জ্বালানো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কেউ কেউ তুমুল বাক-বিতন্ডা সৃষ্টি করেন। কিন্তু শাস্ত্রের বিধান মতে ওলী-আল্লাহগণের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায়, কেননা এঁরা আল্লাহর বন্ধু। এখানে স্মরণ করা যায় যে, মাওলানা সৈয়দ আজিজুল হক চট্টগ্রামী নলতা দরবার শরীফে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহর রওজায় এক ওরশ উপলক্ষে লক্ষাধিক জন সমাবেশে বলেছিলেন, "যে মাজারে ওলী আল্লাহর দেহ সমাহিত হয়, সেই মাজার হেফাজত করা, চারেদিক ঘেরা দেয়া, দেয়াল তৈরী করা এবং মাজারের উপরের ছাদ ও গম্বুজ নির্মাণ করা বিধেয়। এই মাজার চাদরে ঢেকে সু সজ্জিত করা উচিত এবং রাত্রিকালে আলোকসজ্জা করা সুগন্ধি দ্রব্য দ্বারা সুরভিত করা কর্তব্য। যে কোন কবরস্থানে উপস্থিত হ'লে স্বীয় মৃত্যুর কথা স্মরণ হয় ও আল্লাহর কথা মনে আসে। সুতরাং ওলী- আল্লাহর মাজার জিয়ারত সংষ্কার ও সংরক্ষণ কোন অবৈধ কাজ নয়। কাল কিয়ামত পর্যন্ত রূপ বা আত্মা কবরে অবস্থান করে এবং ইচ্ছামত বিভিন্ন স্থানে তা যাতায়াত করে।"

কোরান, হাদীস ও মণীষী ব্যক্তিগণের বাণী থেকে এ কথা অতি স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, ফকির-দরবেশগণ অমর। দেহত্যাগ ক'রে গেলেও তাঁরা তাঁদের মাজারে এবং অন্তরঙ্গ বন্ধুর নিকটে অবস্থান করেন। তাঁদের মাজার, বাণী ও রচনাবলী সংরক্ষণ অতি পবিত্র দায়িত্ব। আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতামহ সূফী সাধক আহসান আলী এই শ্রেণীর একজন স্মরনীয় ও বরণীয় ব্যক্তিত্ব। ভক্ত-মুরিদগণ ও গ্রামবাসী তাঁর নামে 'বজরাহার দরবার শরীফ' প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগ নিয়ে তাঁর কিছু মারেফতী সংগীত সংগ্রহ ক'রে অধ্যাপক খোন্দকার রিয়াজুল হক সাহেবকে দান করেছি। তিনি ঐগুলোর শ্রেণীবিন্যাস করে আহসান আলীর জীবন ও তত্ত্বদর্শন সংক্রান্ত আলোচনার সমন্বয়ে এই গ্রন্থটি রচনা করেছেন। আমি এ গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি। আল্লাহ হাফেজ।

১লা পৌষ,                                                                                                                           খন্দকার মোহাম্মদ আব্দুল গফ্ফার,

১৩৯০                                                                                                                                         বজরাহার দরবার শরীফ,

১৭-ডিসেম্বর, ১৯৮৩                                                                                                                             সিংড়া, নাটোর।