আহসান আলী : ঐতিহাসিক পটভূমি


আহসান আলী : ঐতিহাসিক পটভূমি

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু হয় উনিশ শতকে। এই যুগ-নির্মাণে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ফোর্ট উইলিয়মের পন্ডিতগণই এ যুগের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-মাধ্যম বাংলা গদ্যের স্রষ্টা। বস্তুত গদ্যে লিখিত পাঠ্যপুস্তক ও সমাজ সমালোচনামূলক নকশা এই শতাব্দীর প্রথমার্ধের রচনা। এ ছাড়া কোন উন্নত সাহিত্য-প্রয়াস এ সময়ে দেখা যায় না।

পাঠ্যপুস্তক জাতীয় রচনাই বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শন। বাংলা গদ্যের নির্ণীয়মান রূপের উপর এ সব পাঠ্যপুস্তকের প্রভাব তাই সুদুরপ্রসারী অন্যদিকে সামাজিক নকশা ছিল বাংলা সামাজিক উপন্যাসের সূচনা-পর্ব নির্মাণের সহায়ক উপাদান। এমনি করেই বাংলা গদ্যের আকস্মিক আবির্ভাবে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, এই গদ্য-যুগের শুরুতে বাংলার সনাতন কাব্যধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কবি গরীবুল্লাহর উত্তরসূরী ভারতচন্দ্রের কাব্যে এক সময় বাংলা ভাষার একটি সুমার্জিত কলা সম্মত রসনিপুন ভঙ্গী ও বিশুদ্ধ রীতি ফুটে উঠে। কিন্তু দৈব দূর্বিপাকে ভাষার সেই সাহিত্যিক আদর্শ আর সু প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ পায় না। উনিশ শতকে তাই স্কুল রুচির কবিগান, তরজা, খেউর, হাফ-আখড়াই, অশ্লীল কবিতা ইত্যাদি কলকাতাকেন্দ্রীক নব্য শিক্ষিত সমাজে সাহিত্য-রসের মাধ্যম বলে গণ্য হয়।

উনিশ শতকের শেষার্ধে অবশ্য বাঙ্গালীর সুপ্ত প্রতিভা নতুন করে জেগে উঠে। কিন্তু তখনও বাংলা ভাষার-কি গদ্যে, কি পদ্যে-'এক অপরীসিম দারিদ্র তাকে দারুণ নৈরাশ্যে অভিভূত করে। এই নৈরাশ্য ফোর্ট ইউলিয়ম কলেজের পন্ডিতগণের সৃষ্ট সংস্কৃতবহুল সাধু ভাষার প্রভাবজাত ব'লে অনেকেরই ধারনা। বস্তুত সংস্কৃত প্রধান গদ্য রীতির দৌরাত্ন্যের জন্যে রবীন্দ্রনাথ ও ফোর্ট উইলিয়মের পন্ডিতগণকে দায়ী করেছেন। এমন কি মধুসূদনের কাব্য-ভাষাকেও তিনি পুনর্লিখনের বিষয় বলে ভেবেছেন। তাঁর মতে উনিশ শতকে নির্মিত এই সাধু ভাষার পাশাপাশি আর একটি ভাষা আবহমানকাল থেকেই এ দেশে প্রচলিত রয়েছে। এটিই মূলত সংস্কৃত-প্রভাব-বর্জিত অসাধু ভাষা। কিন্তু অসাধু হলেও এই ভাষাতেই বাংলার মানুষ তার প্রাণের কথাটি যথার্থভাবে বলতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, "এই অসাধু ভাষাটা খুব জোরালো ভাষা এবং তাহার চেহারা বলিয়া একটা পদার্থ আছে। আমাদের সাধু ভাষার কাব্যে এই অসাধু ভাষাকে একেবারেই আমল দেওয়া হয় নাই; কিন্তু তাই বলিয়া অসাধু ভাষা যে বাসায় গিয়া মরিয়া আছে তাহা নহে। সে আউলের মুখে, বাউলের মুখে, ভক্ত কবিদের গানে মেয়েদের ছড়ায় বাংলাদেশের চিত্তটাকে একেবারে শ্যামল করিয়া ছাইয়া রাখিয়াছে।” বস্তুত খাঁটি বাংলা ছন্দ প্রসঙ্গে আলোচনা কালে মরমী কবিদের কাব্য-ভাষার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ মন্তব্য করেছেন। এ ভাষাকে 'প্রাণবান এবং বাঙ্গালীর দিন- রাত্রীর ভাষা' বলে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তা অত্যন্ত মূল্যবান। তাঁর ভাষায় "প্রাকৃত বাংলার দুয়োরানীকে যারা সুয়োরানীর অপ্রতিহত প্রভাবে সাহিত্যের গোয়ালঘরে বাসা না দিয়ে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে, সেই 'অশিক্ষিত লাঞ্ছনাধারীর দল' যথার্থ বাংলা ভাষার সম্পদ নিয়ে আনন্দ করতে বাধা পায় না।”

এই লাঞ্ছনাধারীর দল' বলতে রবীন্দ্রনাথ প্রখ্যাত মরমী কবি লালন শাহ ও তাঁর অনুসারী ভক্ত কবিগণকে বুঝিয়েছেন। রবীন্দ্র রচনায় লালন সংগীতের বিশেষ বিশেষ অংশের উদ্ধৃতি দেখেই তা উপলদ্ধি করা যায়। ফোর্ট উইলিয়মের পন্ডিতেরা 'সংস্কৃতের বেড়া তুলে' যখন বাংলা ভাষার স্বাভাবিক গতিপথকে 'ঠেকিয়ে রেখেছিলেন' লালনই তখন এ দেশের মানুষের প্রাণের গভীর কথা তাঁর সহজ ভাষায় বলে গেছেন। লালন সংগীতে আরোপিত বাউলের সুর গ্রামবাংলার জনসাধারণকে শুধু নয়, তৎকালীন কলকাতাকেন্দ্রিক আধুনিক কবি-সাহিত্যিকগণকেও মুগ্ধ করেছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, অশ্বিনী কুমার দত্ত, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ফারসী কবিগণের প্রতি অনুরাগ এ মণীষীদের আর একটি বৈশিষ্ট্য। বাস্তবিকই লালনের পূর্বসূরী। রুমী-জামী হাফিজ-সাদী'র প্রভারজাত তৎকালীন সাহিত্য-সেবী মহলে বাংলার মরমী প্রভাব কত শক্তিশালী আধিপত্য বিস্তার করেছিল, 'হাফিজ-ই-হাফিজ' দেবেন্দ্রনাথের পুত্র রবীন্দ্রনাথের মানস বিশ্লেষণ করলে তা বুঝা যায়। শুধু তাই নয়, উনিশ শতকের শেষার্ধে ও বিশ শতকের প্রথম দিকের সাহিত্যসেবীদের অনেকেই এই প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। তাই দেখা যায়, আঠার শতক থেকে চলমান পুথি-সাহিত্যের ধারা ও উনিশ শতকের আধুনিক কাব্য-নাটক-উপন্যাস' সাহিত্য ধারার তলে তলে গ্রামীণ সমাজের পটভূমিতে রচিত 'মরমী কাব্য ও সংগীত ধারাটি ছিল অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত প্রবাহমান'। জামাল উদ্দীনের প্রেমরত্ন (১৮৫৩), বুদ্দু শাহর দিদারে এলাহী (১৮৬৬), পাঞ্জু শাহের ছহি ইস্কি ছাদেকী গওহোর (১৮৯০), শের আলীর জোয়াহেরে মারেফাত ইত্যাদি ঊনিশ শতকে রচিত ঐ শ্রেণীর মরমী কাব্যের উজ্জল দৃষ্টান্ত। মরমী সংগীত প্রসঙ্গ অবশ্যই পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।

গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনও বহু সাধক কবির রচনা-নিদর্শন পাওয়া যায়। এঁদের অনেকেই লালন সংগীতের অনুরূপ সংগীত রচয়িতা। শহর থেকে দূরে নিভৃত পল্লীতে বসেই তাঁরা কাব্য-সাধনা চালিয়েছেন, আধুনিক নগর-সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে চাননি। যোগাযোগশূন্য হাওড়-বাওড়, নদী-নালা ও খাল-বিলের কিনারে সাধক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে অধ্যাত্ব-চিন্তায় মগ্ন থাকাই ছিল তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য। লালন-পাঞ্জর উত্তরসূরী এই শ্রেণীর অত্ত্বিক কবিদের মধ্যে চলনবিল অঞ্চলের খ্যাতনামা সাধক আহসান আলী বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর মারেফতী সংগীত ঐ এলাকায় এখনও খুব জনপ্রিয়। ঘাটের মাঝি, মাঠের চাষি, পথের পথিক, দরবারের সূফী, আশ্রমের বাউল, বেতাবের শিল্পী ইত্যাদি আজও এই সাধক কবির গানে উত্তরাঞ্চলের আকাশ-বাতাস মুখর করে রাখে। উনিশ শতকের শেষার্ধ এবং বিশ শতকের এক-চতুর্থাংশ কাল এই কবির মরমী সংগীত সাধনা বহমান ছিল। তার জীবন কথা, তত্ত্বদর্শন ও কবি প্রতিভা পর্যালোচনা থেকে এ কথা আরো স্পষ্টভাবে জানা যাবে।

আহসান আলীর জীবন কথা

আহসান আলী ১২৭০ বঙ্গাব্দে (১৮৬৩ খ্রীঃ) রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার অন্তর্গত রাণীনগর উপজেলার লোহাচুড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পূর্ন নাম আহসান আলী খন্দকার। তাঁর পিতার নাম আজগর আলী খন্দকার এবং মাতার নাম মহরাতুন্নেছা।

আজগর আলী খন্দকার ছিলেন চার সন্তানের জনক। তাঁরা যথাক্রমে - আকবর আলী খন্দকার, আহসান আলী খন্দকার, আবূ তালিব খন্দকার ও ছবেজাননেছা। তাহলে কবিই ছিলেন তদীয় পিতার দ্বিতীয় পূত্র।

শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বাল্যেই কবিকে লোহাচূড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। অতি অল্পদিনের মধ্যে মেধাবী ছাত্র হিসাবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। যথাসময়ে অত্যন্ত গৌরবের সাথে নিম্ন প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বৃত্তি লাভ করেন। কিন্তু আকস্মাৎ পিতৃবিয়োগ হওয়ায় তাঁর শিক্ষা জীবন এখানেই শেষ হয়ে যায়।

পিতার অবর্তমানে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সহযোগী হিসাবে গৃহকর্ম সম্পাদনের আংশিক দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর উপর। কিন্তু সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও কবির মনে প্রবল জ্ঞান-পিপাসা জেগে উঠে। এই পিপাসা নিবৃত্তির জন্যে তিনি গৃহ-শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আসেন। তৎকালীন অভিজাত মুসলিম পরিবারের প্রথা অনুযায়ী কবি আরবী-ফারসী ভাষা শিখতে থাকেন। প্রখর স্মৃতিশক্তি বলে খুব কম সময়ের মধ্যে সমগ্র কুরআন শরীফ তাঁর কণ্ঠস্থ হয়ে যায়। প্রধান প্রধান হাদীছ এবং উল্লেখযোগ্য আরবী- ফারসী গ্রন্থেও তিনি প্রগাঢ় পান্ডিত্য অর্জন করেন।

পুথিগত বিদ্যা অর্জনের পর কবি তত্ত্বজ্ঞান লাভের আশায় উদগ্রীব হয়ে উঠেন। এ উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য দীক্ষাগুরু (মুরশীদ) অপরিহার্য। বস্তুত ধর্ম শাস্ত্রেও এই প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি রয়েছে। যতদিন যায়, কবির মনের গভীর অনুভূতি ততই কবিকে সদ-গুরু সন্ধানী করে তুলে।

দেশ-দেশান্তর গুরুর সন্ধানে ঘুরে অবশেষে তিনি লোহাচূড়া গ্রাম-নিবাসী সকিন আলী খন্দকারের কাছেই দীক্ষা গ্রহণ করেন। সকিন আলী চিশতীয়া তরিকার সাধক ছিলেন। তাঁর শিক্ষাগুনে আহসান আলী শরিয়ত, তরিকত, হকিকত, মারেফত ইত্যাদি চার স্তরেই গভীর জ্ঞানের অধিকারী হন।

পঁচিশ বছর বয়সে রাজশাহী জেলার রাণীনগর উপজেলার পাকশা গ্রামের কুদরতুল্লাহ খন্দকারের কন্যা নূরজাহান বেগমের সাথে কবির বিয়ে হয়। রূপবতী ও গুনবতী এই মহিলা ছিলেন কবির যোগ্য জীবন-সংগীনী। সেবা, সংসর্গ ও সু-পরামর্শ দ্বারা কবিকে সাধন-পথে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

অধ্যাত্ব সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে আহসান আলী সাধক পুরুষ বলে গণ্য হন। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে তিনি গুরু-প্রদত্ত খেলাফত লাভ করেন। তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের পরিচয় পেয়ে এ সময় অনেকেই তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে চান। গুরুর অনুমতিক্রমে কবি তাঁদেরকে সূফীতত্ত্বে দীক্ষা দেন। নবদীক্ষিত এই শিষ্যগণ কবিকে রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার অন্তর্গত সিংড়া উপজেলার বজরাহার গ্রামে নিয়ে যান। বজরাহার চলনবিলের মধ্যভাগে অবস্থিত। ভক্ত পরিবেষ্টিত এই গ্রামে সাধক আহসান আলীর নতুন সাধন-ক্ষেত্র গড়ে উঠে। এখানে ভক্তরাই গুরুর জন্যে তেরী করেন একটি দরবার গৃহ।

১৩২২ বঙ্গাব্দ (১৯১৫ খ্রীঃ) থেকে পরিবার পরিজনসহ কবি বজরাহার গ্রামে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন। চলনবীলের উন্মুক্ত পরিবেশ কবির মনে উদাসী ভাব এনে দেয়। মনের কথা গানের ভাষায় প্রকাশ করা একটি প্রবণতা তাঁর মধ্যে আসে। তিনি ঝরঝরে ভাষায় মারেফতি গান লিখতে শুরু করেন।

এ সময় চলনবিলের সংস্কৃতি অঙ্গন সমৃদ্ধ ছিল। স্থানীয় জমিদার ও তালুকদারগণ শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। চলনবিলের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তৎকালে নাটোর রাজবংশ দিঘাপতিয়া রাজবংশ, নাটোরের চৌধুরী জমিদার বংশ, শীতলাই জমিদার বংশ, হরিপুরের জমিদার বংশ, মাঝগ্রাম জমিদার বংশ, বারুহাস জমিদার বংশ, হান্ডিয়াল জমিদার বংশ ইত্যাদি ঐ এলাকায় বিশেষ প্রভাবশালী ছিল। এই জমিদারদের অনেকেই আবার সংস্কৃতি অনুরাগীও ছিলেন। এ প্রসঙ্গে স্বনামধন্যা মহিলা-জমিদার রাণী ভবানীর নামোল্লেখ করা যায়। তাঁরত দানশীলতা ও মানব-প্রেমের অনেক কাহিনী আজও ঐ অঞ্চলে প্রচলিত আছে।

ঐতিহ্যবাহী এই বিলের মাঝখানে বসেই আহসান আলী অধ্যাত্ব সংগীতের জোয়ার আনেন। ভাবগানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর যাদুর হাতের পরশ লাগে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, কবির সংগীত রচনার সূচনা-বর্ষ (১৯১৫) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা, ঐ বছরই রবীন্দ্রনাথ কুড়িটি লালন সংগীত প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করে লালনকে সুধী সমাজে তুলে ধরেন। একই সালে পূর্বসূরী কবির রচনা-প্রকাশ উত্তরসূরী কবিকে হয়ত বা অলেক্ষ্য প্রেরণা জুগিয়েছিল।

আরো একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আহসান আলীর সংগীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে লালন-প্রভাব শুধু নয়, পাঞ্জ-প্রভাব ও যথেষ্ট কার্যকর হয়েছিল। মরমী কবি পাঞ্জু শাহ (১৮৫১-১৯১৪) চলনবিলের মধ্যস্থ বিভিন্ন গ্রামে এক সময় যাতায়াত করতেন। ঐ এলাকার প্রতিটি গ্রামেই পাঞ্জুর একাধিক শিষ্য ছিলেন, তাঁদেরই মাধ্যমে পাঞ্জ-সংগীত ও পাঞ্জ-কাব্য আহসান আলীর দৃষ্টি আকর্ষন করে। ঠিক এ সময় কোন এক শিষ্য-বাড়ি ভ্রমণকালে পাঞ্জু শাহের সংগে আহসান আলীর সাক্ষাৎ ঘটে। ধীরে ধীরে উভয় কবির মধ্যে হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। অতঃপর আহসান আলী পাঞ্জু শাহের অনেক গান সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো পঠন-পাঠনেও যত্নবান হন। আহসান আলীর গানে পাঞ্জ সংগীতের সাদৃশ্য দেখে একথা বোঝা যায়।

আরো একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আহসান আলীর সংগীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে লালন-প্রভাব শুধু নয়, পাঞ্জ-প্রভাব ও যথেষ্ট কার্যকর হয়েছিল। মরমী কবি পাঞ্জু শাহ (১৮৫১-১৯১৪) চলনবিলের মধ্যস্থ বিভিন্ন গ্রামে এক সময় যাতায়াত করতেন। ঐ এলাকার প্রতিটি গ্রামেই পাঞ্জুর একাধিক শিষ্য ছিলেন, তাঁদেরই মাধ্যমে পাঞ্জ-সংগীত ও পাঞ্জ-কাব্য আহসান আলীর দৃষ্টি আকর্ষন করে। ঠিক এ সময় কোন এক শিষ্য-বাড়ি ভ্রমণকালে পাঞ্জু শাহের সংগে আহসান আলীর সাক্ষাৎ ঘটে। ধীরে ধীরে উভয় কবির মধ্যে হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। অতঃপর আহসান আলী পাঞ্জু শাহের অনেক গান সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো পঠন-পাঠনেও যত্নবান হন। আহসান আলীর গানে পাঞ্জ সংগীতের সাদৃশ্য দেখে একথা বোঝা যায়।

আহসান আলী তত্ত্বসংগীতের রচয়িতা। এ সংখ্যায় এগুলো কত ছিল, তা আজও জানা যায়নি। মুখে মুখেই এসব গান বিভিন্ন অঞ্চলে ফিরেছে। তাঁর গান সংগ্রহের তেমন কোন উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। তবো পাঞ্জ পুত্র খোন্দকার রফিউদ্দীন তদীয় 'ভাবসংগীত' শীর্ষক গ্রন্থে আহসান আলীর দু'টি গান সংকলিত করেছেন। প্রখ্যাত গবেষক এম,এ, হামিদ টি,কে, রচিতা' 'চলনবীলের ইতিকথা'। ও চলনবিলের লোকসাহিত্য নামক গ্রন্থে কবির দুটি করে গান দেখা যায়। "বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বেগম জাহান আরা রচিত বাংলাদেশের মরমী সাহিত্য' গ্রন্থেও কবির দুটি গান আছে এছাড়া মুদ্রিত আর কোন পুস্তকে এই কবির রচনা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।

কবি আহসান আলী ১৩৪০বঙ্গাব্দে (১৯৩৩ খ্রীঃ) ২৭শে ফাল্গুন রোববার, সকাল ৮ঘটিকায় ইহলোক ত্যাগ করেন। শেষ বিদায়ের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বৎসর। ঐ সময় তাঁর স্ত্রী, পুত্র খন্দকার মুহম্মদ আবুল কাশেম ও খন্দকার মুহম্মদ আতোয়ার রহমান এবং কন্যা ছকিনা খাতুন জীবিত ছিলেন। বজরাহার গ্রামে নিজস্ব বসতবাটীতে কবি সমাহিত আছেন। প্রতি বছর তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে ঐ মাজার প্রাঙ্গণে ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। কবির শিষ্য-প্রশিষ্য এবং বহু শিল্পী-সাহিত্যিক এ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।

আহসান আলীর তত্ত্বদর্শন

পৃথিবীতে প্রচলিত বিভিন্ন উপাসনা পদ্ধতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে মোটামুটি তিনটি পদ্ধতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে। এগুলো হচ্ছে- স্বারূপ্য, ঐশ্বর্য ও মাধুর্য।

স্বারূপ্য সাধনার বৈশিষ্ট্য: স্রষ্টার স্বরূপ চিন্তা করা এবং তাঁকে নিজ অন্তরে উপলদ্ধি করা। স্রষ্টার স্বরূপ চিন্তা করতে করতে নিজের মধ্যেই ভক্ত তাঁর অধিষ্ঠান উপলদ্ধি করেন। স্রষ্টা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য-আমরা স্রষ্টাকে সৃষ্টি করি আমাদের মনের মত করে নিজ নিজ মনের ভাব, ভাষা, অনুভূতি এবং মাধুরী মিশিয়ে। স্রষ্টাকে তাই আমরা সর্বদায় আমাদের মনের রঙ্গে অনুরঞ্জিত করে দেখি। স্রষ্টাকে মানুষ নিজের মত করেই চিন্তা করেছে, কখনও বা নিজেকেই স্রষ্টা বলে ধরে নিয়েছে। তাই দেখা যায়, মানুষই বলেছে, অহংব্রহ্ম, আনাল হক বা আমিই সত্য ইত্যাদি। উপনিষদ বা বেদান্তে এর প্রকাশ।

দ্বিতীয় পদ্ধতি-ঐশ্বর্য পূজা। আমাদের মধ্যে যে সমস্ত গুন রয়েছে, তার পরিপূর্ণতা আমাদের মধ্যে কখনও ঘটেনা। তাই এ সব গুনের পূর্ণতা দিয়ে আমরা স্রষ্টাকে গড়ে নিই। তিনি সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কর্তা, পরম জ্ঞানী, দাতা, দয়ালু, সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান ইত্যাদি। মানুষ তাঁর দাসানুদাস। এ ভাবেই মানুষ স্রষ্টার প্রতি আস্থা স্বীকার কৃতার্থ হয়েছে। সেবার দ্বারা উপাসনার দ্বারা স্রষ্টাকে তুষ্ট করতে পারলেই ঐহিক ও পারত্রিক মংগল, মানুষের মুক্তি ও মানব জন্মের চরম সার্থকতা। এ পর্যায়ে পড়ে পৌরাণিক হিন্দু ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম।

তৃতীয় পদ্ধতি-মাধুর্যপূজা। এখানে স্রষ্টা উপলদ্ধির বিষয় নন, পরম ঐশ্বর্যবান নন, তিনি পরম প্রেমিক। শুধু মাত্র হৃদয়-নিসৃত প্রেমের মধ্য দিয়েই তাঁকে লাভ করা যায়। তিনি প্রেমের ‘ঠাকুর’ বা 'মনের মানুষ'। এই মধুর রসের সাধনাই মুসলিম সূফী সম্প্রদায়ের সাধন রীতি। প্রেম- সাধনাকেই সূফীরা সার্থক সাধনা বলে মনে করেন।

এই প্রেম-সাধনা মূলত 'মরমী তত্ত্ব সাধনা' ইসলামী পরিভাষায় যাকে 'ফকিরী বলা হয়। এ ফকিরী স্বয়ং স্রষ্টারই এক বিশেষ 'সিফত' বা গুন। হাদীছ শরীফে আছে 'তাখালাক্কু বি আখলাকিল্লাহ' অর্থাৎ আল্লাহর গুনে নিজেকে গুণান্বিত কর।' এই হিসেবে প্রত্যেক মুসলমানকে ফকিরী জীবন যাপন করতে হবে। সূফীরা তাই বিশ্বাস করেন 'আল্লাহ পয়লা ফকির, হযরত মুহম্মদ (দঃ) দ্বিতীয় ফকির, হযরত আদম তৃতীয় ফকির এবং হযরত আলী চতুর্থ ফকির। বস্তুত হযরত আলী থেকেই 'ইসলামী ফকিরী মত' বা 'সূফীবাদ' প্রকাশ্যভাবে প্রচারিত হয়ে পড়েছে। রাছুল থেকে প্রাপ্ত তত্ত্বকথা আলীর হৃদয়ে গুপ্তভান্ডারের মত ছিল। আলীর শিষ্য হাসান বসরীর মাধ্যমেই তা ভক্তদের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে।

হাসান বসরীর দুজন প্রধান শিষ্য-আব্দুল ওয়াহেদ বিন জায়েদ এবং হাবিব আজমী যথাক্রমে 'জায়েদিয়া' ও হাবিবীয়া নামক দুটি সূফী তরিকা প্রবর্তন করেন। জায়েদিয়া তরিকা থেকে চারটি (আয়াজিয়া, আদহামিয়া, হুবায়রিয়া, চিশতীয়া) এবং হাবিবীয়া তরিকা থেকে আটটি (কার্থিয়া, সাতাকিয়া, তৈফুরিয়া, জুনাদিয়া, গুজরুনিয়া, ভার্তাওসিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, ফিরদৌসিয়া বা কুরবায়ী) শাখা তরিকার জন্ম হয়। জায়েদিয়া ও হাবিবীয়া এবং উক্ত বারটি শাখা তরিকা একত্র মিলে 'চৌদ্দ তরিকা' বা চৌদ্দ খানওয়াদা' নামে পরিচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে কেবল চারটি তরিকা (চিশতিয়া, কাদরিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, নকশাবন্দীয়া) বা চার ঘরনা প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। বাকি ঘরানাগুলো বা তরিকাগুলো এই চার ঘরানার উপ-ঘরানা রূপে চালু থাকে।

সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকার সূফিরাই সর্বপ্রথম এ দেশে আসেন। কিন্তু পরে এসেও চিশতীয়া খান্দানী তাপসগণ বাংলাদেশের জনমনে বিশেষ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। খাজা মঈনুদ্দীন চীশ্ তীর কথা স্মরণ করলে এর সত্যতা জানা যায়। কার্যতঃ ইনিই পাক-ভারত বাংলাদেশের চিশতিয়া পন্থীদের অগ্রদূত এবং আবু ইসহাক শামী চিশতী কর্তৃক প্রবর্তিত চিশতিয়া তরিকার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী, ফরিদউদ্দীন গঞ্জ-ই-শোকর এবং নিযামউদ্দীন আউলিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরাই মূলত সমগ্র উপমহাদেশে মঈনুদ্দীনের বাণী ও আদর্শ প্রচার করেন। নিযামউদ্দীনের সুযোগ্য শিষ্য আখী সিরাজউদ্দীন সূফীবাদ প্রচারে বাংলাদেশের গৌড়-পান্ডুয়ায় আসেন। এই দরবেশের প্রচেষ্টাতেই চিশতী-নিযামী সাধন পন্থা বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। এঁরই উপযুক্ত শিষ্য আলাউল হক এবং প্রশিষ্য নূর কুতুবুল আলম আজীবন প্রচার কার্য চালিয়ে যান। কুতুবুল আলমের অন্তরংগ অনুগামী শাহ জাহিদ বিন জাহিদ, প্রশিষ্য দরবেশ শাহকাজী শেখ, উপ- প্রশিষ্য শাহনূর মখদূম হামিদ প্রমূখ সূফীবাদে নিহিত প্রেম-ভক্তির মর্মকথা প্রচারের বলে ধর্মপ্রাণ বাঙ্গালীর হৃদয়ে একটি স্থায়ী আসন পেতে বসেন। বহিরাগত এই সূফীদের কাছে বাংলাদেশের অগনিত লোক দিক্ষিত হন। নব-দিক্ষিত এই শিষ্যদের অনেকে সিদ্ধ সাধকে পরিণত হয়ে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে তত্ত্বজ্ঞান সঞ্চারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খান্দানী পীরের শিষ্য হিসেবে তাঁরাও মূলত খান্দানী সূফী-সাধক। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা বিপর্যয়ে তাঁদের পরিচয় ঢাকা পড়েছে। তাই সূফীমতাবলম্বী দেশীয় তাপস মন্ডলীর পরিচয় ঢাকা পড়েছে। তাই সূফীমতাবলম্বী দেশীয় তাপস মন্ডলীর জীবন ও কীর্তির ইতিহাস লিখতে গেলে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য মিলেনা। আরো দেখা যায়, বাহ্য শরিয়তপন্থী প্রবক্তাদের প্রতাপে তাসাওয়াফ পন্থী দরবেশী মতের উদারচেতা ফকির সম্প্রদায়ের অনেকেই প্রচ্ছন্নভাবে নিজস্ব শিষ্যমন্ডলীর মধ্যে জীবন কাটিয়ে লোকান্তরিত হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তত্ত্বজ্ঞানী সাধক তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের সূত্র বাইরে প্রকাশ করতে চাননি। অবশ্য এর পিছনে সংগত কারণও ছিল। বিদ্বানেরা বলেন, "সূফীবাদ কোন প্ররোচনায় জন্মগ্রহণ করেন নি। হযরত মুহম্মদের পর তদীয় ধর্মপ্রাণ শিষ্যদের মধ্যে এই ভক্তিভাব প্রসার লাভ করে। সূফীরা অনাড়ম্বরপ্রিয়। তাঁদের মতবাদ প্রচারমূখী নয়। সূফী-সাধক যখন গুরুর নিকট দীক্ষা লাভ কারে ধ্যানস্থ হন, তখন বাহ্য জগতকে মতায়ত্ব করার অভিলাষ তাঁর মনেই আসতে পারে না। সূফী-সাধু যে সত্যে উপনীত হন, তা তিনি সাধারণকে বুঝান সম্ভবপর মনে করেন না।” এ সব কারণে বিশেষ করে বাংলাদেশের সূফীতত্ত্বের ইতিহাস প্রায়ই অনুপস্থিত। সে জন্যে আঠার- উনিশ শতকের বাংলার সূফী-সাধনার ধারাবাহিক কোন বিবরণই পাওয়া যায় না। এ সময়ের সাধকেরা প্রায়ই ক্ষেত্রে বেশরা ফকির, লৌকিক পীর, বাউল-গরু ইত্যাদি অধ্যায় আখ্যায়িত। সংগীত-প্রিয় সাধকগণের প্রতি গোড়া সমাজের উপেক্ষার মনোভাব থাকায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। অথচ 'চিশতিয়া' ও সোহরাওয়ার্দীয়া সম্প্রদায়ভুক্ত দরবেশগণের মধ্যে গান-বাজনা একটি অপরিহার্য বিষয়। এই দুই সম্প্রসায়ভুক্ত সাধকেরা গান- বাজনার সাহায্যে হৃদয়কে উত্তেজিত করে অধ্যাত্মভাবে বিভোর হন। এরূপ উত্তেজনার অবস্থায় কখনও তাঁরা নাচতে থাকেন, কখনও ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এ সব কারণে ভূল বুঝা বুঝির সৃষ্টি হওয়ায় দেশীয় সূফীরা ইতিহাসে অবহেলিত, রাজ-শক্তি কর্তৃক উপেক্ষিত এবং সমাজ-মানস থেকে পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছেন।

উনিশ শতকের মরমীরা ভাবসাধক লালন শাহকে নিয়ে এই সমস্যা আরো প্রকট। যদিও তিনি সারা জীবন অসংখ্য অনুগামীকে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের নির্দেশ দিয়েছেন, তবু তাঁকে খান্দানী ফকির বলে মেনে নিতে অনেকরই আপত্তি। লালনের মত ও পথের প্রকৃত ভিত্তি যে সূফীবাদ, একথা তাঁরা স্বীকার করতে চান না। কিন্তু প্রকৃত সন্ধানীর মতে লালন দরবেশ ছিলেন। কবীর, নানক, দাদু, তুলসী দাস প্রভৃতির ন্যায় সন্ত-পুরুষ- ছিলেন। রুমী, জামী, সাদীর মত সূফী ছিলেন।" কোন দলীলবিহীন নতুন- মতবাদের প্রচারক তিনি নন- একথা প্রমাণ করতে গিয়ে মোল্লাদের সাথে তাঁকে বাহাছ করতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর শিষ্যদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরেছে। আখড়াতেও বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে। নিঃসন্তান, লালনের কোন শিষ্য বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব নিয়ে তাঁর আদর্শবাদ প্রচারে অগ্রসর হননি। লালন-শিষ্য দুদ্দু শাহ নিজস্ব সংগীত রচনায় আত্মনিয়োগ করেন, মনীরুদ্দীন শাহ তদীয় শিষ্য খোদা বকশ শাহের মাধ্যমে ফরিদপুর (আলমডাঙ্গা, কুষ্টিয়া) থেকে লালন সংগীত প্রচারে অগ্রসর হন, অন্যান্য শিষ্যরা ভাবের ভাবুক হয়ে উদাসী বাউলের ভাব ধরেন কিন্তু কেউই লালন আশ্রমকে একটি সু-প্রতিষ্ঠিত দরবেশের দরবার রূপে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হননি। নেতৃত্বের অভাবে লালন সংগীত, লালন-চিন্তা, মত পথ নির্দেশ এবং ধর্মাদর্শ সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

লালনের ভাব-শিষ্য পাঞ্জু শাহের (হিরাজতুল্লাহ খোন্দকারের শিষ্য) ক্ষেত্রে এর কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষিত হয়। পাঞ্জু শাহ চিশতিয়া খান্দানের নিযামিয়া গোরো অনুসারী ফকীর বলে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচিত সুফী-তত্ত্বমূলক গ্রন্থ ও মারেফতি সংগীতে তাঁর মত ও পথের দিশা আছে। পরবর্তীকালেও পাঞ্জ-পূত্র খোন্দকার শামসুদ্দীন ও খোন্দকার রফিউদ্দীন পাঞ্জুর বাণী, দর্শন ও মতবাদ প্রচার করেছেন। পাঞ্জু শাহকে নিয়ে তাই বিভ্রান্তি অনেকটা কম।

লালন পাঞ্জুর উত্তর সূরী সূফী সাধক আহসান আলীর ক্ষেত্রেও ঐসব সমস্যা দেখা দিয়েছে। দেহত্যাগের পঞ্চাশ বছর পরও তিনি সুধী সমাজে অজ্ঞাত। তাঁর মতাদর্শ ও সাহিত্য-চিন্তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। বেশরা-বেদীন-বেদাতী ফকির বলেই তিনি উপেক্ষিত। তাঁর মাজারে অনুষ্ঠিত বাৎসরিক ওরশেরও অনেক সমালোচনা। সংগীত পরিবেশনা নিয়ে বহু বাকবিতন্ডা অথচ তথ্য সংগ্রহে দেখা যায়, কবি চিশতীয়া খান্দানভুক্ত নিযামিরা গোরো অনুসারী ফকির। অন্যান্য ওলি-আল্লাহর মাজারে অনুসৃত রীতি-পদ্ধতি অনুসারেই তার মাজারে ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে থাকে মিলাদ-মাহফিল, কোরানখানি, সিজরা পাঠ, জিগির-আশকার, সামা গজল বা অধ্যাত্ম সংগীত পরিবেশন ইত্যাদি। কবির বংশধর এবং শিষ্য-প্রশিষ্যদের বেশ-ভূষা, আচার-আচরণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেও কোন আপত্তিজনক লক্ষণ আবিষ্কার করা যায় না। আগেই বলেছি, স্রষ্টা ও পীর-মুরশীদ স্মরণে তত্বসংগীত চর্চার রীতি চিশতীয়া সম্প্রদায়ের সাধকগণের মধ্যে চালু আছে। তাছাড়া কবিমন সর্বদা নিরপেক্ষ মানবতার ভক্ত। কবি আহসান আলীও সেকারণ তত্ত্বগীতি ও মানবপ্রীতি হৃদয়ে লালন করেছেন সারা জীবন।

তাই দেখা যায়, জগত বিখ্যাত সূফীদের অধঃস্তন উত্তরাধিকারী আহসান আলী মারেফতী সংগীতের সুর লহরীতে চলনবিল অঞ্চলে ভাবের জোয়ার এনেছিলেন। সে জোয়ারে এখনও ভাটা পড়েনি। এখনও ভক্তের ভক্তি উৎসারিত হয় সাধকের আস্তানায়। অসংখ্য সূফী সাধকের পূণ্যভূমি রাজশাহীর সংস্কৃতি-দেহে তিনি আজও প্রাণ সঞ্চার করে চলেছেন। শাহ মখদুম, শাহ দৌলা, শাহ আব্দুল ওহাব প্রমুখ দরবেশের মর্মবাণী তাঁরই কন্ঠে ব্যক্ত হয়েছে সুর ও ছন্দে। এই কবির দর্শন-চিন্তা ও কবি-কীর্তি সম্যকভাবে উপলদ্ধি করার আবশ্যকতা আছে।

আহসান আলীর কবি প্রতিভা

আহসান আলী মূলত গানের কবি। মারেফতী গান বা তত্ত্ব সংগীত রচনার মধ্যেই তাঁর বাণী-সাধনা সীমাবদ্ধ ছিল। গুরুর উপদেশে তাঁর হৃদয়ে যে মরমিয়া ভাবের উদয় হয়েছিল, আগামী দিনের মানুষের জন্যে কবি সে ভাবেরই ছন্দবদ্ধ বিকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন গানে। সংগীত সাধনায় আহসান আলীর সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল মানুষ এবং মানুষের বিচিত্র জীবন। এ দেশের মানুষ চিরদিনই আধ্যাত্মিকতার ভক্ত। "সংগীত হোক, সাহিত্য হোক, সব কিছুর মধ্যেই আমাদের জনসাধারন একটু তত্ত্বকথা, একটু আধ্যত্মিক জ্ঞান লাভ করতে চায়, স্রষ্টার সাথে আমাদের মনের যোগ যে বিনে তারে গাঁথা রয়েছে সেখানে ঝংকার না উঠলে আমাদের পল্লীবাসী পুরোপুরি আনন্দ লাভ করতে পারে না"। "কবি আহসান আলী তাই বাংলাদেশের মানুষের সেই আনন্দ রসের সূত্র ধরেই দেহতত্ত্বমূলক ও আধ্যাত্মিক চিন্তা সম্বলিত সংগীত রচনা করেছেন। তাঁর গানের কথা ও সুর শুনলে বিষয়টি উপলদ্ধি করা যায়।

আহসান আলী-রচিত সংগীত নানা শ্রেণীতে বিভক্ত। এগুলো। হচ্ছে-আল্লাহতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, বেলায়েতত্ত্ব, তরিকতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, রূপতত্ত নামাজতত্ত্ব ও হজ্বতত্ত্ব, মেরাজতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব, ইত্যাদি।

আল্লাহতত্ত্ব, গানগুলোতে স্রষ্টার একত্ম, কলেমার মাহাত্ম্য, মানুষের অস্তিত্ব, নফি-এছবাত জিগির পদ্ধতি, শয়তানের ধোকা ভঞ্জনের উপায়, আখেরী যামানার বৈশিষ্ট্য, কোরানের শিক্ষানীতি ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি কবির সশ্রদ্ধ মন্তব্য স্মরণীয়।

নবীতত্ত্ব সংগীতে নবীর মাহাত্ম্য, কুরান-হাদীছে বর্ণিত নবীর গুরুত্ব ইসলামের চারপন্থা (শরীয়ত, তরিকত, হকিকত, মারেফত) অনুসরণের তাকিদ মানুষ মুহম্মদের বিশেষ ব্যাখ্যা, ধর্মের পঞ্চ স্তম্ভের স্বরূপ বিশ্লেষণ, খলিফাগণের গুনাবলী, ইহজগত, পরজগত, নূরের খবর ইত্যাদি রমণীয় ভাষায় বর্ণিত হয়েছে।

বেলায়েততত্ত্ব, গানগুলো স্রষ্টা, সৃষ্টি, আল্লাহর নবী, আল্লার বান্দা, নর-নারী ও বিবিধ গৃহ্য বিষয় বর্ণনার জন্যে লিখিত।

চার তরিকের (চিশতিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, কাদরিয়া, নকশা বন্দিয়া) উদ্ভব, বিকাশ এবং ক্রমোন্নতি সম্পর্কে কবির স্বাধীন ও দলীল সম্মত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তরিকতত্ত্ব, গানগুলোতে। এতে কবি-অনুসৃত তরিকার খবরও মিলেছে।

গুরুতত্ত্ব গানের সংখ্যা সর্বাধিক। গুরুই সূফীদের একমাত্র পথের দিশারী। আহসান আলী তাঁর গুরুতত্ত্ব গানগুলোতে একথাই ব্যক্ত করেছেন। গুরুর সমার্থক শব্দ হিসেবে আরবী 'মুরশীদ'এবং ফারসী 'পীর' শব্দের প্রচলন আছে। কবির গানে তারও দৃষ্টান্ত মিলে। 'মুরশীদ-বরজোখ' বা 'গুরু-রূপ' হৃদয়ে ধারণ ক'রে সেই নিরাকার স্রষ্টার সাথে ভক্তিমার্গে মিলনের কথাও কবি অতি প্রাঞ্জল ভাষায় বলে গেছেন। রূপতত্ত্ব গানগুলো এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

নামাজের প্রয়োজনীয়তা, নামাজ-মাহাত্ম্য ও রকমারী নামাজের স্বরূপ-স্বতন্ত্র্য ব্যাখ্যাত হয়েছে নামাজ তত্ত্বমূলক সংগীতে। এ প্রসঙ্গে রোজা, হজ্ব, যাকাত, কলমা ইত্যাদি বিষয়েও কবি সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আরও উল্লেখ্য যে, শরীয়তের নামাজ, তরিকতের নামাজ, হকিকতের নামাজ ও মারফতের নামাজ সম্পর্কেও কবির মতামত এ গানেই আছে। এছাড়া ঈমান বা বিশ্বাসই যে ধর্মের মূল কবি এখানে তাও বলে গেছেন।

'হজ্জতত্ত্ব’ শীর্ষক গানে কবি হজ্বের তাৎপর্য যথার্থ স্বরূপ এবং মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে নবীর দিদার বিষয়ক গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশের চাতুর্য তাত্ত্বিক ভক্তদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ গ্রন্থে 'হজ্বতত্ত্ব' গানগুলো নামাজতত্ত্ব গানগুলোর সংগে সংকলিত হয়েছে।

মেরাজ-মাহাত্ম্য ‘মেরাজতত্ত্ব’ সংগীতে বর্ণিত আছে। ‘দেহতত্ত্ব’, মরমী সাধকগনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 'ভান্ডে ব্রক্ষ্মান্ড' এ-তত্ত্ব প্রায় সকল মরমী সাধকই স্বীকার করেন। বস্তুত বিশ্ব প্রভূর আসন কোন উর্দ্ধেলোকে নয়, মানুষের মনের মনিকোঠায় অর্থাৎ এই মাটির দেহেই তাঁর অবস্থান' এই সহজ সত্যটি আহসান আলীর দেহতত্ত্ব সংগীতগুলোর মধ্যে ফুটে উঠেছে। দেহ জরীপ করে আট কুঠুরী নয় দরজা, চারিচন্দ্র, ত্রিবেণী, নূর, নীর, ছয় লতিফা, আঠার মোকাম, বার বরোজ, চার চিড়িয়া, চার কুতুব ইত্যাদি তত্ত্ব বিভিন্ন প্রতীক ও রূপকের মাধ্যমে বিশ্লেষিত হয়েছে মানব দেহকে কোথাও ঘরের সাথে, কোথাও নৌকার সাথে, কোথাও রা রেলগাড়ী-মটর গাড়ীর সাথে তুলনা করতে দেখা গেছে।

‘মান আরফা নফছাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু' (যে ব্যক্তি নিজেকে চিনেছে, সে প্রভুকেও চিনেছে) হযরত আলীর এই বিখ্যাত বাণীর প্রতিধুনী শোনা যায় আহসান আলীর 'আত্মতত্ত্ব' শীর্ষক গানে।

স্রষ্টাকে লাভ করার গৃহ্য সাধন-প্রণালী বর্ণিত হয়েছে 'সাধনতত্ত্ব' শীর্ষক গানগুলোতে। অজুদ-এবাদত, যোগ-সাধন, অটল-সাধন রস-সাধন, শক্তি-সাধন, পেয়ালা-সাধন, মীন-সাধন, চন্দ্র-সাধন ইত্যাদি অতি কৌশলে তিনি বর্ণনা করেছেন।

স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে প্রভুভৃত্য সম্পর্ক নয়, বরং প্রেমিক-প্রেমাষ্পদ বা আশেক-মাশেক সম্পর্ক-এই তত্ত্বটি ফুটে উঠেছে আহসান আলীর প্রেমতত্ত্বমূলক গানে। এ প্রসঙ্গে কিশোর-কিশোরীর জাগতিক প্রেম এবং রাধাকৃষ্ণের লীলা-মাহাত্ম্য প্রচারেও কবির কৃতিত্ব প্রশংসনীয়।

মানব জীবনের পূর্বাপর অবস্থা, জীবন লাভের উদ্দেশ্য, কর্তব্য সাধনের উপায়, সংসারের অনিত্যতা, কর্মফলের আশা-নিরাশা ইত্যাদি মূর্ত হয়ে উঠেছে পরমতত্ব সংগীতে।

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ-আশরাফুল মখলুকাত। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে ভালবাসা প্রকৃত মনুষ্যত্ব। জাত্যাভিমানের অহংকার, আভিজাত্যের বড়াই এবং পার্থিব দাম্ভিকতা বর্জন করে বিশ্বপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবার তাকিদ রয়েছে আহসান আলীর মানূষ্যতত্ত্ব গানে। 'এই মানুষে আছে রে মন, যারে বলে মানুষ রতন,' অথবা 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, এই সত্যের সাধক ছিলেন কবি আহসান আলী।

উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) মৃত্যুর আট বৎসর আগেই আহসান আলী (১৮৬৩-১৯৩৩) দেহত্যাগ করেন। জন্ম সাল হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা দুই বছরের ছোট। ১৯১৫ থেকে আহসানের সাহিত্য সাধনা অর্থাৎ সংগীত রচনা আরম্ভ হয়। এ সময় রবীন্দ্রনাথের প্রধান প্রধান কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং লালন ফকিরের মনের মানুষতত্ত্ব প্রভাবে রবীন্দ্র-মানসে জীবন দেবতা তত্ত্বের উন্মেষ-পর্বও শেষ হয়েছে। আহসান আলী যে রচনা সম্ভার উপহার দিয়েছেন, তা মূলত রবীন্দ্র-কাব্য সাধনার প্রখর দীপ্তির যুগে সৃষ্ট। কিন্তু রবীন্দ্র-যুগের কোন প্রভাব তাঁর সংগীতে নেই। আধুনিক গীতি কবি-গোষ্ঠীর কাব্য-চিন্তার কোন প্রতিফলনও তাঁর রচনায় দৃষ্ট হয় না। মরমিয়া ভাবচিন্তাই তাঁর কাব্য সাধনার মূল। বাস্তবিক পক্ষে আধুনিক বাংলা সাহিত্য সাধনার অলক্ষ্যে এই মরমী-কাব্যসাধনা চলেছে। মরমী কবিরা আধুনিক কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হননি, বরং আধুনিক কবিরাই মরমী কবিদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এ প্রভাব পরিহার করতে পারেননি। তাঁর অনেক গানে বাউলের সুর সংযোজিত হয়েছে। অনেক গানে কবির জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে 'বাউল সুরে'র মিল ঘটেছে। এ সব কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন। তাছাড়া কবি বা গীতিকারগণের আধূনিক হওয়ার প্রশ্ন এক প্রকার বাতুলতা। যে যুগেই তাঁরা সংগীত রচনা করুন না কেন, শাশ্বত বাংলার প্রাণের কথা তাতে থাকবেই। সে কথা, সে অভিব্যক্তি চিরন্তন, আবহমানকাল যাবত তা শ্রুতিমধুর, পুরাতন হয়েও তা চির নতুন। আহসান আলী সেই চির নতুনের কবি, চির সুন্দরের সংগীত সাধক। তাঁর গানের ভাষা প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য এবং সুমিষ্ট। আরবী-ফারসী শব্দের ব্যবহার থাকলেও সকলেই তা বুঝতে পারে। কোরআন হাদীছের কিছু আয়াতাংশ একটু অর্থভেদের অপেক্ষা রাখে বটে, কিন্তু মূল বক্তব্য তাতে ক্ষুন্ন হয়নি। পরিশেষে বলতে হয়, সাধারণ সাহিত্য-সাধকগণ তাঁদের বাণী ও সুরকে চিরন্তন আবেদনশীল এবং সাধনক্ষেত্রকে পীঠস্থানে পরিণত করতে পেরেছেন ব'লে আমরা জানি না। কিন্তু মরমী কবিরা তা পেরেছেন। কবি আহসান আলী সেই বিচারে অন্যন্য খ্যাতি ও অক্ষয় আসনের অধিকারী।